নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী মাধ্যমিকের সব শিক্ষার্থীই সব বিষয়ে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়বে। এই স্তরের শিক্ষাক্রমে বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা ও মানবিকের মতো আলাদা বিভাগ আর থাকবে না। নতুন এ পদ্ধতিকে সাধুবাদ জানালেও এর বাস্তবায়নে তিনটি চ্যালেঞ্জ দেখছেন শিক্ষাবিদরা।
শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে জানান, মাধ্যমিকের নতুন পাঠক্রমে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষার মতো আলাদা আলাদা বিভাগ থাকছে না। মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড বিল পাসের প্রক্রিয়ায় বিরোধী দলের বিভিন্ন প্রস্তাব নিয়ে জবাব দেওয়ার সময় তিনি এ কথা জানান। দীপু মনি বলেন, আমাদের কারিকুলামের পুরো পর্যালোচনা হচ্ছে। শিগগিরই চূড়ান্ত রূপটি প্রকাশ করব। সেখানে সব ধরনের শিক্ষাতে বিজ্ঞান, মানবিক, ব্যবসা- এই বিভাগগুলো নবম-দশম শ্রেণিতে আর রাখছি না। সব শিক্ষার্থী সব ধরনের শিক্ষা নিয়ে স্কুলের ১০টি বছর শেষ করবে। জানা গেছে, ২০২২ সাল থেকে পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যে প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে পাঠক্রমে পরিবর্তন আনা হবে।
বিভাগ না রাখার সুবিধা-অসুবিধা সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আমাদের সময়কে বলেন, এটি ভালো সিদ্ধান্ত। আসলে এটি (বিভাগ বিভাজন) না থাকাই ভালো ছিল। এখন থাকায় তুলে দিচ্ছে এবং সেটি ভালো পদক্ষেপ বলে আমি মনে করি। তিনি বলেন, মাধ্যমিকে এ বিভাজন খুব কার্যকর হয় না। ওই লেভেলে শিক্ষার্থীরা সিদ্ধান্ত নিতে পারে না যে, কোন স্ট্রিমে তারা যাবে। অনেক সময় অভিভাবকদের চাপে চলে যায়। পরে বুঝতে পারে সেটি তার জন্য যথার্থ নয়। কিন্তু তখন আর ফেরার কোনো পথ থাকে না। তাই আমার মনে হয় ইন্টারমিডিয়েটে গিয়ে শিক্ষার্থীরা সিদ্ধান্ত নেবে যে কোন বিভাগে যাবে। এর আগে একটা জেনারেল এডুকেশন থাকা দরকার। যার মাধ্যমে তারা সব কিছু সম্পর্কে জানবে এবং অন্য বিষয়গুলোর সঙ্গে ইন্টারেকশন করতে পারবে। তবে আমি মনে করি, শিক্ষার্থী তার আগ্রহের ভিত্তিতে সাবজেক্ট নেবে। এ অপশনটা থাকা দরকার।
শিক্ষাবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, ২০১০ সালের শিক্ষানীতিতে বলা আছে, একমুখী শিক্ষার কথা। সরকারের এটি ইতিবাচক উদ্যোগ। তবে এর বাস্তবায়নের জন্য তিনটি চ্যালেঞ্জ আছে। কারণ আমরা ‘সৃজনশীল’ পদ্ধতি চালুর পর দেখছি এর সুফল ততটা আসেনি। শিক্ষকরাই বিষয়টি আয়ত্ত করতে পারেননি। ফলে পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ছেলেমেয়েরা এর ভুক্তভোগী। অথচ এটি ভালো মূল্যায়নের একটি নির্দেশক। সরকারকে নতুন কারিকুলাম চালুর আগে যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে- এক. সর্বপ্রথম শিক্ষকদের এ বিষয়ে দক্ষ করে তোলা। তাদের প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে। দুই. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো নিশ্চিত করা। তিন. এ জন্য বড় একটি বাজেট বরাদ্দের প্রয়োজন। শুধু বরাদ্দ হলেই হবে না, যথাযথ মনিটরিং থাকতে হবে। এই কাজগুলো করার আগে অবশ্যই স্কুল ম্যাপিং করতে হবে। কোথায় কী কী ঘাটতি রয়েছে, চিহ্নিত করার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
বুয়েটের সিএসই বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. কায়কোবাদ বলেন, শিক্ষার কারিকুলাম সময়ে সময়ে পরিবর্তন-পরিমার্জন করতে হয়। একই বিষয় দীর্ঘদিন পড়ানো হয় না। সময়ের প্রয়োজনে বৈশ্বিক চাহিদার ভিত্তিতে এটি পরিমার্জনের প্রয়োজন পড়ে। আমাদের যে কারিকুলাম এতদিন চর্চা করছি, এটি নিয়ে সরকারের নিশ্চয় কোনো গবেষণা থাকতে পারে যে, এ মুহূর্তে এর চেয়ে আরও উন্নত দক্ষতা অর্জন করতে হবে আমাদের। সেই পথে যেতেই নতুন কারিকুলামের প্রয়োজন। এটি ইতিবাচক উদ্যোগ। এখন দশম শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীর পাঠক্রম একই থাকবে। এতে তাদের শেখার ভিত্তি শক্ত হবে। একাদশ শ্রেণিতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা বিভাগ বা শাখায় ভাগ হয়ে যাওয়ার সুযোগ পাবে।
তিনি বলেন, একটি নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের পর ফল পেতে দীর্ঘ সময় লাগে, এর বড় চ্যলেঞ্জ থাকবে। শুধু কারিকুলাম পরিবর্তন নয়; শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো, শিক্ষায় বরাদ্দ এসবেও নজর দিতে হবে।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এতদিন নবম-দশম শ্রেণিতে শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা ও মানবিক বিভাগ বেছে নিয়েছে। এখন এই স্তরে কোনো বিভাজন থাকবে না। একাদশ শ্রেণিতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা বা মানবিক বিষয় নিয়ে পড়তে পারবে। তবে এটিকে আগের মতো বিজ্ঞান, ব্যবসায়, মানবিক বিভাগ হিসেবে নামকরণ করা হবে না। মূল তিনটি বিষয়ের সঙ্গে গুচ্ছ বিষয় থেকে পছন্দের বিষয় নির্বাচন করার সুযোগ থাকবে একজন শিক্ষার্থীর। যেমন- একজন শিক্ষার্থী চাইলে পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞানের সঙ্গে হিসাব বিজ্ঞানও পড়তে পারবে। আবার কেউ ব্যবসা উদ্যোগ, হিসাব বিজ্ঞানের সঙ্গে উচ্চতর গণিত পড়তে পারবে। বাংলা, ইংরেজির সঙ্গে আরেকটি বিষয় অত্যাবশ্যকীয় থাকবে। বাকিগুলো পছন্দ করে মোট ১১০০ নম্বরের বিষয় নিয়ে পড়তে পারবেন একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা।
Leave a Reply